সূর্যমুখী তেলের উপকারিতা, অপকারিতা ও বর্তমান দাম: জেনে নিন সূর্যমুখী বীজ ও তেলের সঠিক মূল্য
সূর্যমুখী তেলের পরিচিতি?
সূর্যমুখী তেল (Sunflower Oil) আমি সর্বপ্রথম চিনতাম না। কখনো ভাবতেও পারি নি যে সূর্যমুখী ফুল থেকে তেল হয়। তো একদিন হটাৎ করেই সূর্যমুখী তেল সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মালো। জানতে পারলাম যে এটি তৈরী হয় সূর্যমুখী ফুলের নির্যাস থেকে। অবশ্য আগে থেকে জানতাম যে, সূর্যমুখী গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Helianthus annuus, এবং এই তেলে প্রচুর পরিমান ভিটামিন E এবং ওমেগা-৩ এসিড থাকে। বাড়িতে আম্মু মাঝে মধ্যেই দেখি যে সূর্যমুখীর তেল দিয়ে রান্না করে। আম্মু বার বারই বলতো যে "সূর্যমুখীর তেল এর খাবার খা বেশি করে, এটি ত্বকের জন্য অনেক উপকারী"।
সূর্যমুখী তেলের বিভিন্ন প্রকার:
অনেক খোঁজাখুঁজির পর সূর্যমুখীর তেলের কয়েকটা প্রকার বের করতে পেরেছি। যদিও এগুলোর ডিটেলস বলতে গেলে আপনাদের এই আর্টিকেলটা পড়তে বোরিং লাগতে পারে। তাই বললাম না। নিচে কয়েকটা প্রকার উল্লেখ করলাম।
- হাই-ওলিক (High Oleic) সূর্যমুখী তেল
- মিড-ওলিক (Mid-Oleic) সূর্যমুখী তেল
- লিনোলিক (Linoleic) সূর্যমুখী তেল
- নিউট্রা-ফ্লো (NuSun) সূর্যমুখী তেল
- অপরিশোধিত (Unrefined) সূর্যমুখী তেল
- রিফাইন্ড (Refined) সূর্যমুখী তেল
সূর্যমুখী তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা
আগেই যেহেতু আম্মুর প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে ফেলেছি, তার থেকেই আবার শুরু করি আম্মু সবসময়ই রান্না করবার সময় বলতো এই তেলে অনেক উপকারিতা আছে। যেহেতু এতে বেশি পরিমানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড থাকে সেহেতু এর উপকারিতা অনেক থাকবে এইটা স্বাভাবিক। তাই বলে কি এর অপকারিতা থাকবে না? অবশ্যই আছে। সেগুলো একটু আস্তে আস্তে বলি? পড়তে থাকো পুরো প্রবন্ধটি।
সূর্যমুখী তেলের উপকারিতা
সূর্যমুখী তেলের উপকারিতার কথা বেশি শুনেছি অপকারিতার তুলনায়। আমার আম্মু যে যে উপকারিতার কথা বলেছে সেগুলো বৈজ্ঞানিক ভাবেও প্রমাণিত। সবগুলো উপকারিতা আমি মিলিয়ে নিয়ে আপনাদের কাছে শেয়ার করছি।
১. হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক
আমার চাচার হার্ট এ সমস্যা আছে। আম্মু বার বার বলতো যে বেশি করে সূর্যমুখীর তেল খেতে , কাহিনীটাই বুঝতাম না , অবশেষে জানলাম সূর্যমুখী তেল ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ, যা শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যার ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস পায়।
২. ত্বকের যত্নে বিশেষ ভূমিকা
আগেই একবার বলেছিলাম এই তেল ত্বক ভালো রাখতে সাহায্য করে। যেহেতু সূর্যমুখী তেলে ভিটামিন E প্রচুর পরিমাণে থাকে, যা ত্বকের কোষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং ত্বককে কোমল ও মসৃণ করে। সূর্যমুখী তেল প্রাকৃতিক ময়েশ্চার হিসেবে কাজ করে যার ফলে ত্বক শুস্ক থাকে।
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
আমাদের ঘরে রোগবালাই কমই থাকে যার কারণ হিসেবে বলতে পারি সূর্যমুখীর তেল। যেহেতু সূর্যমুখী তেলের মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বহুগুন।
৪. হজম শক্তি বাড়ায়
এই তেলটি হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। পরিপাকতন্ত্র কে সুস্থ রাখে। প্রয়োজনীয় হরমোন গুলোকে একটিভ করে।
৫. স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস
সূর্যমুখী তেলে মোনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড এবং পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি পরিমাণে থাকে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এগুলো হৃদরোগ এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
৬. শক্তি বাড়াতে সহায়ক
একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে আমি শক্তিশালী অনুভব করি । ঠিক আমার মতোই যারা সুর্জনমুখীর তেল ব্যাবহার করে তারাও অনেক শক্তিশালী হয়ে থাকে। এটি দৈনন্দিন শারীরিক কার্যকলাপে শরীরকে সক্রিয় এবং কর্মক্ষম রাখে।
৭. ইনফ্ল্যামেশন কমায়
সূর্যমুখী তেল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাগুণ সম্পন্ন, আমাদের শরীরে যদি কোনো পচন ধরা শুরু করে তাহলে সেটি রোধ করে থাকে সূর্যমুখীর তেল এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
৮. ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক
আগেই বলেছি সূর্যমুখী তেলে থাকে ভিটামিন E এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে কোষগুলোকে রক্ষা করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে। আম্মু অবশ্য স্তন ক্যান্সারের কথা উল্লেখ করেছিল।
সূর্যমুখী তেলের অপকারিতা :
অনেকতো হলো উপকারিতার কথা এবার চলুন একটু অপকারিতার কথা বলি. আমি এর মাঝে বিশেষ কিছু অপকারিতা এবং পার্শপ্রতিক্রিয়া খুঁজে পেয়েছি সেগুলোই শেয়ার করছি এখন।
১. ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের উচ্চ মাত্রা:
আমি জানতে পেরেছি সূর্যমুখী তেলে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড (বিশেষ করে লিনোলিক সূর্যমুখী তেলে) থাকে। যদিও ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়, তবে এর অতিরিক্ত গ্রহণ ওমেগা-৩ এর সাথে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে। ওমেগা ৩ টি আমাদের শরীরের জন্য বেশি উপকারী।
২. উচ্চ তাপমাত্রায় ক্ষতিকর যৌগ তৈরি:
এই তেল আমরা যখন অনেক বেশি তাপমাত্রায় ব্যাবহার করি তখন ফ্রি র্যাডিকাল এবং অন্যান্য ক্ষতিকর যৌগ তৈরি হতে পারে। এই ফ্রি র্যাডিকালসমূহ শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়াতে পারে, যা ক্যান্সার, হৃদরোগ, এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।
৩. ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি:
অতিরিক্ত পরিমানে তেল খেলে শরীরে ফ্যাটের পরিমান বাড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে ওজন বাড়বে। সূর্যমুখীর তেল ও এর ব্যাতিক্রম নয়।
৪. প্রদাহ বৃদ্ধির সম্ভাবনা:
পূর্বেই বলেছি যে এটিতে অধিক মাত্রায় ওমেগা-৬ থাকে। অতিরিক্ত ওমেগা-৬ গ্রহণ শরীরে প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া বাড়াতে পারে। প্রদাহ দীর্ঘমেয়াদে আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত সমস্যার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।
৫. অপরিশোধিত সূর্যমুখী তেলের সংরক্ষণ জটিলতা:
অপরিশোধিত সূর্যমুখী তেল দ্রুত অক্সিডাইজ হয়ে ক্ষতিকর যৌগ তৈরি করতে পারে। এটি তেলের গুণমান নষ্ট করতে পারে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যখন এটি ভুলভাবে সংরক্ষণ করা হয়।
৬. অ্যালার্জি সমস্যা:
আমার নিজেরও প্রচুর এলার্জির সমস্যা। সূর্যমুখীর তেলে অনেকের এলার্জি হতে পারে। তবে সবার না কিছু ব্যাক্তিবিশেষ এমন হতে পারে।
৭. হাই-ওলিক তেলের ক্ষতিকর ফ্যাটি অ্যাসিডের সমস্যা:
হাই-ওলিক সূর্যমুখী তেল বেশ স্বাস্থ্যকর হলেও এটি প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবারের সাথে নিয়মিত গ্রহণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
৮. ভেজাল ও নিম্নমানের তেলের ব্যবহার:
আমি বাজারে গিয়ে দেখেছি বেশিরভাগ সূর্যমুখী তেল ভেজাল বা নিম্নমানের, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। নিম্নমানের তেল গ্রহণ করলে এটি দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি করতে পারে।তাই সকলের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
সূর্যমুখী তেলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
আমি অপকারিতা গুলো উপরেই উল্লেখ করেছি, অল্পের মধ্যে বলতে গেলে সূর্যমুখীর তেল ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের ভারসাম্যহীনতা, প্রদাহ বৃদ্ধি, ওজন বৃদ্ধি এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের ঝুঁকি বাড়ায়। কিছু মানুষের এলার্জি অথবা শাসকষ্টও হতে পারে।
কেন সূর্যমুখীর তেল অন্যান্য তেল থেকে আলাদা?
আম্মুর থেকে জানা যে সূর্যমুখীর তেল অন্যান্য তেল থেকে আলাদা। কারণ গুলো অনেক কষ্টে রিসার্চ করে পেলাম সেগুলোই শেয়ার করছি :
১. উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন ই:
কয়েকবার বলা হচ্ছে তবুও বলি সূর্যমুখীর তেল পর্যাপ্ত পরিমান ভিটামিন ই সমৃদ্ধ। যা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। যা অন্য সব তেলে পাওয়া যায় না।
২. অস্বাস্থ্যকর ফ্যাটের কম পরিমাণ:
এই তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের মাত্রা খুব কম, HDL এর মাত্রা বেশি হওয়ায় এটি হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো যেটি অনন্য।
৩. অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল কমাতে সহায়ক:
যেহেতু HDL এর মাত্রা বেশি তাই LDL এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এটি। এতে মনো-আনস্যাচুরেটেড এবং পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের উচ্চ মাত্রা রয়েছে, যা "খারাপ" কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে এবং "ভালো" কোলেস্টেরল (HDL) বাড়াতে সহায়ক। এজন্যই বেশি পরিমানে পরিবারের সবাই এই তেল খাই আমরা।
৪. সুবিবেচনামূলক গন্ধ ও স্বাদ:
অন্যান্য তেলের গন্ধ আমার ভালো লাগে না। যেহেতু এটি ফুলের বীজ থেকে তৈরী সেহেতু এটি অন্য সব ফুল থেকে ঘ্রান ভালো হওয়াটাই স্বাভাবিক।
৫. উচ্চ তাপমাত্রায় রান্নায় উপযুক্ত:
আমরা অনেক সময় উচ্চতাপমাত্রায় রান্না করলে আমাদের তেলের গুনাগুন নষ্ট হয়ে যায় সেক্ষেত্রে এটি ব্যাতিক্রম। এটি উচ্চ তাপমাত্রায় রান্নার জন্য উপযুক্ত (হাই স্মোক পয়েন্ট), যা ভাজার সময় পুষ্টিগুণ ধরে রাখে এবং রান্নার জন্য নিরাপদ।
সূর্যমুখী বীজের দাম:
আমি পুরো বাংলাদেশের মার্কেট খুঁজে যা পেয়েছি তাই শেয়ার করছি বর্তমানে ৫০০ গ্রাম সূর্যমুখী বীজের দাম ৬৫০ টাকা এবং ১ কেজির দাম ১৩০০ টাকা। আন্তর্জাতিক মার্কেটে আবার কিছুটা আলাদা। অঞ্চল ভেদে দাম আলাদা আলাদা হয়। সাধারণত প্রতি কেজি বীজের দাম $০.৬৫ থেকে $৪.৩১ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আর্জেন্টিনায় দাম $০.৬৫ থেকে $০.৯৫ প্রতি কেজি, আর উত্তর আমেরিকায় এটি $৪.৩১ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
সূর্যমুখী তেলের দাম ১ লিটার:
আমি সূর্যমুখী তেলের দামের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা দেখেছি। বাংলাদেশে দারাজে দেখলাম এক একজন সেলার এক এক দামে বিক্রি করছে তবে সূর্যমুখী তেলের দাম প্রতি লিটারে প্রায় ৬৭২ টাকা থেকে শুরু হয়, যা ব্র্যান্ড ও উৎপত্তিস্থান অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানিকৃত সূর্যমুখী তেল বাজারে বেশি জনপ্রিয়। উদাহরণস্বরূপ, ১ লিটারের একটি বোতলের দাম প্রায় ৬৭২ টাকা, এবং বড় বোতল যেমন ১.৫ লিটার বা ১.৮ লিটার এর দাম ১,১২৯ থেকে ১,৫৩৯ টাকার মধ্যে থাকে।
উপসংহার:
আমি এই পুরো আর্টিকেলটি আমার জীবনের সাথে মিলিয়েই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। কোনো তথ্য সম্পর্কে যদি সন্দেহ থাকে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।
নার্সিং এডমিশন একাডেমির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url